আজ ১৭ই মে। মৃত্যুর সার্ধশতবর্ষ দিবসে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলী।
লিখেছেন প্রখ্যাত অঙ্কোলজিস্ট সাহিত্যে রবীন্দ্র পুরস্কার প্রাপ্ত
ডঃ শঙ্কর কুমার নাথ
উনিশ শতকের মাঝামাঝি গুটিবসন্ত রোগের ভয়াবহ প্রাদুর্ভাবে বাংলার গ্রাম-শহর আতঙ্কিত হয়ে
ওঠে। সমাজে ত্রাসের সঞ্চার হয়, যদিও অনেক আগেই চালু হয়ে গিয়েছিল বাংলা টিকা
(Inoculation) এবং ইংরেজি টিকা (Vaccination) পদ্ধতি। মৃত্যুর হার বৃদ্ধি পাচ্ছিল। সরকার
কালবিলম্ব না করে গুটি বসন্ত রোগের প্রেক্ষিতে একটি বিশেষ কমিটি গঠন করে দেয়। সেই
কমিটিতে ছিলেন ডাক্তার ল্যাম্ব (ফিজিশিয়ান জেনারেল), ডাক্তার ফরসাইথ (মেডিকেল বোর্ড
সচিব), ডাক্তার ডি, স্টুয়ার্ট (টিকা ব্যবস্থার অধীক্ষক), বাবু রসময় দত্ত কোর্ট অফ রিকোয়েস্টের
কমিশনার), বাবু রামগোপাল ঘোষ (ব্যবসায়ী), পন্ডিত মধুসূদন গুপ্ত
(মেডিকেল কলেজের শিক্ষক) এবং মিস্টার ডবলু, টি, ল ( পুলিশ সুপার)।
এই কমিটি সামগ্রিকভাবে এই রোগ সম্পর্কে অনুসন্ধান করে রিপোর্ট জমা দিয়েছিলেন ১৮৫০ সালের ১লা জুলাই।
এই অনুসন্ধানের একটা অংশে ছিল সমাজের কয়েকটি বিশিষ্ট মানুষের কাছে গুটি বসন্ত সম্পর্কে
চারটি প্রশ্ন পাঠিয়ে দেওয়া আর তার উত্তর চাওয়া। এই বিশিষ্ট মানুষদের মধ্যে ছিলেন রাধানাথ
শিকদার- যাঁর কাছেও উত্তর চাওয়া হয়েছিল।
কী উত্তর দিয়েছিলেন রাধানাথ।
প্রঃ ১) কোন টিকাদার টিকাকরণ করবার পরে কোনো পরিবারে কোন গুটি-বসন্তের প্রাদুর্ভাবের
ঘটনা কি আপনি জানেন? আর এর ফলে কি সেই পরিবারে এই রোগ অন্যদের মধ্যেও ছড়িয়েছিল বা মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছিল?
উঃ – কলকাতার হিন্দু সমাজের একটি সামাজিক প্রথা যে, পরিবারেরর কেউ একজন বাংলা টিকা
গ্রহণ করলে, অন্যান্য সকলেই, অর্থাৎ যারা আগে বাংলা টিকা নেননি বা গুটি বসন্তে ভোগেননি
তাঁরা একই সঙ্গে টিকা গ্রহণ করেন। এর থেকে মনে হতে পারে, বাংলা টিকাকরণের পর সৃষ্ট গুটি-
বসন্ত যে ছড়িয়ে পড়ে, তা হিন্দুরা জানে। আমি অবশ্য, বাংলা টিকাকরণের পর কোন মৃত্যুর খবর জানিনা।
প্রঃ ২) আপনি জানেন কি, এমন কোন সমাজ হিন্দু- পরিবার আছেন যাঁরা, এমন ইংরেজি টিকা
গ্রহণ করেছেন এবং বাংলা টিকা বর্জন করেছেন? উদাহরণ দিলে ভালো হয়।
উঃ – প্রথম উদাহরণ হল, বাবু রাধানাথ সেনের তিন সন্তানকে ইংরেজি টিকা দেওয়া হয়েছিল।
কিন্তু এই বছর এদের সকলের বাংলা টিকাকরণ করা হয় এই মনে করে যে, এটা ইংরেজি টিকার
চেয়ে নিরাপদ। একই কারণে বাবু গোপীনাথ সেনের দুই মেয়েকেও পূর্বে ইংরেজি টিকা দিলেও এবার
বাংলা টিকা দেওয়া হয়েছে। এ-বছর বাবু হরচন্দ্র ঘোষের মেয়ের ইংরেজি টিকাকরণ হয়েছে। তিন্
মাস আগে বাবু জগদীশনাথ রায়ের দুই সন্তানের ইংরেজি টিকাকরণ হয়েছে। আমি সদ্য খবর পেলাম
যে, বরাহঙ্গরের এক সম্ভ্রান্ত ব্রাহ্মণ পরিবারের ইংরেজি টিকাকরণ হয়েছে প্রায় পঁয়তাল্লিশ বছর
আগেই। আমি অবশ্য এই ঘটনাটি সম্পর্কে সম্পূর্ণ নিশ্চিত নই, তবে প্রয়োজন হলে আমি এ-
সম্পর্কে অনুসন্ধান কর্তে পারি।
প্রঃ ৩) এখনও বাংলা টিকাকরণকে পছন্দ করেন অথচ ইংরেজি টিকাকরণকে নিরুৎসাহ করেন,
এমন কোন সম্ভ্রান্ত হিন্দু পরিবার আপনার জানা থাকলে বলুন।
উঃ – আমার মনে হয়, ইউরোপীয়ানদের সংস্পর্শে থাকা সামান্য কয়েকজন হিন্দু ভদ্রলোকই ইংরেজি
টিকার সুবিধা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল, আর সেই কারণেই তাকে আংশিকভাবে উৎসাহিত করেন। কিন্তু
নোটিধ অধিবাসীর অধিকাংশই সেই বাংলার টিকাকরণের পক্ষে।
প্রঃ ৪) কি কি কারণে আপনার মনে হয়, গুটিবসন্তে হিন্দুরা ভোগেন এবং সে রোগ কোন কোন
নির্দিষ্ট এলাকার সম্প্রসারিত হয়ে যায়?
উঃ – আমার ধারণা যে, গুটিবসন্ত রোগটি একজনের দেহ থেকে আরেকজনের দেহে সংক্রামিত হয়
এবং এলাকার অবস্থা স্বাস্থ্যকর কিনা তার উপর তা নির্ভর করে না। আমার মনে হয় এই বিষয়ে
সাম্যক ধারণা তৈরী করতে গেলে ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে যে মৃত্যুর রেজিস্ট্রার রাখা আছে, তা পরীক্ষা
করে দেখতে হবে যে, গুটিবসন্ত এ-ঋতুতে স্বাস্থ্যকর এলাকায় নাকি অস্বাস্থ্যকর এলাকায় বেশি
হয়েছে, নাকি উভয় এলাকাতেই ঘনঘটাটি সমান।
আমি শুনেছি মৃত্যু রেজিস্ট্রার খুব যত্ন সহকারে রাখা হয় সেটা একটা বিশ্বস্ত ডক্যুমেন্ট হিসাবে কাজে লাগবে।
এই ছিল উত্তর রাধানাথ শিকদার মহাশয়ের। উত্তরের মধ্যেই বেশ কিছু প্রশ্ন তুলে দিয়েছিলেন তিনি।
সংক্রমণের সময় মনে হয় না তাঁর মতো তেজস্বী মানুষের কথা ?