সুদীপ পাঠক
বিয়ে বাড়ীতে সানাই বাজছে , তার মন কেমন করা সুর বহু দূর থেকে উৎসব বাড়ীর আহ্বান জানাচ্ছে । কাছে আসতেই চোখ ধাঁধানো রোশনাই ।
চেনার চাইতে অচেনা মানুষের ভীড় বেশী । চতুর্দিক সরগরম । সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠতেই আরেক দফা আলোর ঝলকানি ! কনের সাজে সুসজ্জিতা
হয়ে সে বোসে আছে সিংহাসনে । তাকে ঘিরে একদল কুচোকাঁচা আর অল্প বয়সী মেয়েবৌয়ের ভীড় জমেছে । উপহারের মোড়ক হতে নিয়ে তার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই সে বলল -- একিগো কাকাই , তুমি তো এক্কেবারে বুড়ো হয়ে গেছ দেখছি । সঙ্গে সঙ্গে হাল্কা হাসি আর ফিসফিসানি গুঞ্জন ধ্বনি কানে আসতে লাগলো । আমি নীরব থাকি , এটাতো কোনো প্রশ্ন নয় যে উত্তর দেবো । প্রগলভতা মিশ্রিত একটা লঘু মন্তব্য মাত্র । মৌনতাই এর যোগ্য জবাব হতে পারে , তাই স্মিতহাস্য ধরে রাখি ঠোঁটে । এরপর বিবাহের নানাবিধ আচারঅনুষ্ঠানের সাক্ষী থাকলাম । কিছু লৌকিক আর কিছু শাস্ত্রীয় বিধি মেনে যেমনটা হয় আর কি । অল্প কিছু মুখে দিতে হয় না হলে খারাপ দেখায় যে , তাই নিয়মরক্ষে করার জন্য পংক্তিভোজনে বসলাম । তারপর চলে এলাম সবার চোখের অলক্ষ্যে , কেউ জানতেও পারলো না ।
রাতে বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ করে ভাবি এই সেই গুবলি ! যাকে কোলেপিঠে করে বড় করেছি ! কতবার হিসু করে জামা ভিজিয়ে দিয়েছে তার হিসাব নেই । আজ তার বিয়ে হয়ে গেল ! অতি স্বাভাবিক বিষয়ে মানুষ কেন এতো অবাক হয় ? ভেবে নিজেই অবাক হলাম ! বিবাহের কথা পাকা হলে পাত্রপাত্রী উভয়ের মনই আনন্দে নেচে ওঠে , এতো নতুন কিছু নয় । তবে বিয়ের পিঁড়িতে বসলে মেয়েদের বোধহয় এক ধরণের লাইসেন্স প্রাপ্তি ঘটে । হঠাৎ সে নিজেকে একটু বেশী পরিপক্ক ভেবে ফেলে । তাই বাচালতা অথরাইজড হয়ে যায় বোধহয় । আজ যেমন গুবলির ক্ষেত্রে হলো । আজ সে যে আচরণ করলো তা অপ্রত্যাশিত । অতীতে কখনো সে একাজ করেনি , সে প্রশ্নই ওঠে না । একবার মনে হলো আমি অকৃতদার বলেই কি এই ব্যঙ্গ মিশ্রিত খোঁচা ? নাহ্ এই সব অসংলগ্ন ভাবনার কোনো পরিণতি নেই । শারীরিক ক্লান্তিতে দু ' চোখের পাতা ভারী হয়ে এলো , আমি ঘুমিয়ে পড়লাম ।
মাঝে পাঁচটা বছর পার হয়ে গেছে , গতকাল পৌরসভা হসপিটালের দোরগোড়ায় হঠাৎ গুবলির সঙ্গে দেখা । আমার নাটকের দলের একটি ছেলে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছে । খবর পেয়ে খোঁজ নিতে ছুটে এসেছিলাম । দেখা করে অনেক গল্প গুজব করলাম । ভোকাল টনিক যাকে বলে আর কি । বেরিয়ে আসছি অকস্মাৎ গুবলির মুখোমুখি ! ঘর্মাক্ত কলেবর , শাড়ীজামার অবস্থা আলুথালু , রুক্ষ মাথায় কোনো প্রকারে একটা হাত খোঁপা বাঁধা । সিঁথিতে পুরোনো তেলচিটে সিঁদুর লেপ্টান , চোখের তলায় গাঢ় কালো ছাপ , মুখমণ্ডলে বিরক্তির ভাব প্রকট হয়ে আছে । বামদিকে একটা বছর দুয়েকের বাচ্ছা প্রায় ঝুলন্ত অবস্থায় মাকে আঁকড়ে ধরে আছে আর নাগাড়ে কেঁদে চলেছে । ফ্রকপরা দেখে কন্যা সন্তান বলেই আন্দাজ করলাম । গুবলির ডান হাতে একটা প্লাস্টিকের ক্যারিব্যাগ আর সস্তা মোবাইল ফোনের হ্যান্ডসেট ধরা । আমাকে দেখে যেনো ভূত দেখার মতন চমকে উঠলো । এক লহমায় নিজেকে সামলে নিয়ে সে যথাসম্ভব চেষ্টা করে মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল -- কাকাই তুমি এখানে , কি ব্যাপার গো ? আমি কারণ দর্শালাম । তারপর বললাম -- তুইতো দেখছি একেবারে পাকাগিন্নী হয়ে উঠেছিস ! জমিয়ে সংসার করছিস তাই না ?
বলামাত্র যেনো অগ্নিতে ঘৃতাহুতি হলো । গুবলির মুখ থেকে হাসি উধাও হয়ে গেল এবং পাংশুবর্ণ ধারণ করলো । আমি প্রমাদ গুনলাম , কোথাও কোনো ভুল করে ফেলেছি নাকি ! এরপর যা ঘটল তার জন্য আমি বিন্দুমাত্র প্রস্তুত ছিলাম না । দু ' চোখ ভরা জল নিয়ে গুবলি অনর্গল এবং অজস্র কথা বলে যেতে লাগলো যার সারমর্ম হলো এই যে : পাঁচ বছরের বিবাহিত জীবনে সে তিনটি কন্যা সন্তানের জন্ম দিয়েছে । বড়টির বয়স চার বছর , পরের দুটি যমজ । তাদেরই একজনকে নিয়ে আজ হাসপাতালে এসেছে ঘ্যানঘ্যানে সর্দিজ্বরের হাত থেকে মুক্তির উপায় খুঁজতে । পরপর মেয়ে বাচ্ছার জন্ম দেওয়ার অপরাধে সে এখন একঘরে। শ্বশুরবাড়িতে নিত্যদিন তার কপালে শুধু লাঞ্ছনা গঞ্জনা আর অপমান বরাদ্দ হয়ে আছে । স্বামী স্ত্রীর সহবাস বন্ধ হয়েছে বহুদিন হলো । প্রয়োজন ছাড়া কোনো বাক্যালাপ হয় না । নিজের শোবার ঘর থেকে পর্যন্ত বিতাড়িত সে । তিন মেয়ের সঙ্গে রান্নাঘরের পাশে খাওয়ার জায়গায় বিনিদ্র রাত কাটে তার । স্বামী তো বটেই এমনকি বিবাহিতা ছোট ননদ পর্যন্ত এখন তার গায়ে হাত তোলে ।
এতো অকপটে এ সমস্ত কথা গুবলি আমাকে বলতে পারবে তা কল্পনাও করতে পারিনি। আহত মানুষের যখন দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যায় তখন লজ্জা শরমের পর্দা খসে পড়ে । আউটডোরের সময় পার হয়ে যাচ্ছে , তা ছাড়া এসব কথা তো ফুরোবার নয় । গুবলি ছুটে চলে গেল হন্তদন্ত হয়ে । মনে মনে বললাম গুবলি মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যেই তুই যে বুড়ি হয়ে গেলি দেখছি ! শব্দ গুলো কিন্তু মুখ ফুটে বাইরে বেরোয়নি , কি দরকার থাক না । শুনলে কষ্ট পাবে , আমার তো কারোকে আঘাত দেবার কথা নয় ।
সমাপ্ত