উপলব্ধি


উপলব্ধি


ফস্বলের এক মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান আমি। আমার বড় হয়ে ওঠা আমার সব চাওয়া পাওয়া সবের সাথে ছোট থেকেই মধ্যবিত্ততা জড়িয়ে থেকেছে। চাকুরিজীবি মা বাবাকে ব্যস্ততার মধ্যে দিন কাটাতে দেখেছি। ছোট থেকে দেখে এসেছি মা সেই সবার আগে ঘুম থেকে উঠে বাড়ির কাজ সেরে, রান্না করে, আমাদের জন্য খাবার বেড়ে ঢাকা দিয়ে অফিস গেছে।
আজ আমি চাকরিসূত্রে বাড়ির বাইরে। তা বেশ অনেকগুলো বছর হয়ে গেল একাই থাকি কোলকাতায়। ব্যাচেলার জীবন, খানিকটা ঝক্কিহীনতার বসেই খাবার দাবারের পাট বাইরেই সেরে ফেলি। কখনো ফুটপাতের হোটেল তো কখনো অফিসের ক্যাফেটেরিয়া। ঘর পরিষ্কার ন'মাস ছ'মাসে ওই উৎসবের মতো আর কি! কাপড় কাচা, ইস্ত্রি করা পাট করা জামা প্যান্ট - সেসবও ওই লন্ড্রির উপর দায়িত্ব দিয়ে আমি ঝাড়া হাতপা। সুতরাং বাড়ির বাইরের উপর ভরসা করে আজ আমি অনেকগুলো বছর কোলকাতাকে উপভোগ করে গেছি। বারান্দা দিয়ে South City Residence, ছাদে উঠে আলোময় শহরেও একটু তারা দেখা, বৃষ্টির দিনে বাড়ির লোকজনকে লুকিয়ে বাজ পড়ার ছবি তোলা (তারপর যদিও বকুনি মিস করিনি)।
এভাবেই বেশ কাটছিল। দুদিনের বেশি ছুটি পেলেই বাড়ি যাওয়া, weekend- এ বেরোনো, আড্ডা, বারান্দা - ছাদ - জানলা দিয়ে দূর দেখা, হটাৎ করে করোনা নামক মহামারী থাবা বসালো গোটা পৃথিবী জুড়ে। শুরু হলো দেশ জোড়া Lockdown, তার সাথে আমাদের গৃহবন্দি দশা। সারাদিন ঘরে বসে বই পড়া, সিনেমা দেখার শেষেও যখন হাঁপ ধরে যাচ্ছিল, তখন রান্না করে সময় কাটানোর চেষ্টা করছিলাম। আমার মতো মানুষেরও কিনা প্রথম প্রথম রান্না করতে বেশ ভালই লাগছিল, আর তার সাথে সামাজিক মাধ্যমে নানান রকমের খাবারের ছবি ভরিয়ে অনেকের Master Chef হওয়ার চেষ্টায় আমিও এটা ওটা নিয়ে পরীক্ষা শুরু করে দিলাম। এই অবস্থায় তিন চারদিন কাটার পর অফিস থেকে সিস্টেম এলো। শুরু হল Work from home। ব্যাস! সেখানেই আমার Master Chef হওয়ার স্বপ্নও ভেঙে গেলো।
দিন যায়, কাজ বাড়ে। বাড়ে বিরক্তি। অফিসের কাজের মাঝে রান্না, কাজে বসার আগে বাসন ধুয়ে দুপুরের রান্নার জোগাড় সেরে রাখা। জোগাড় বলতে ওই ভাত, আলু সেদ্ধ আর ডিম। তাও কখনো স্বাদ বদলাতে ভাজা, বা সেদ্ধ, কিম্বা ঝোল। তবে শুরুর দিকে ভাবতে পারলেও, এখন সেটা এসে দাঁড়িয়েছে ভাত, আলু সেদ্ধ আর ডিম সেদ্ধতেই। এসবের মাঝে লিস্ট মিলিয়ে বাজার করা, বাজার থেকে ফিরে রান্না করা, তাও আবার সেই এক সেদ্ধ। খেতে ভালোবাসা আমি এসব দেখে দেখে শরীরের কথা না হয় বাদই দিলাম, মন আরো দুর্বল হতে লাগল। কম মাইনের চাকরি আর করোনার আতঙ্ক আমায় অনলাইন খাবারের থেকে খানিকটা দূরেই রেখেছে। আর এতেই আরো বেড়েছে বিরক্ত।
একদিন রবিবার রান্না করার মাঝেই আমার চাকুরীজীবি মায়ের ফোন। কি খাচ্ছি, কি করছি ইত্যাদি কথা হতে হতে জানতে পারলাম উনিও রান্না করছেন। এমনিতেই খেটে খেটে আমি বিরক্ত, তাতে আবার এত প্রশ্নের জবাব, মুখ ফসকে বিরক্তি প্রকাশ পেতেই মা বুঝতে পারল আমার প্রতিদদিনের এত কাজ সামলে না পেরে ওঠার যন্ত্রনা। সব বুঝে মা খুব আস্তে আস্তে বললো "ভেবেছিস আজ তেত্রিশ বছর আমার Lockdown এ কেমন কাটছে, তুই তো এই কয়েকদিনেই হাঁপিয়ে গেলি।"
এটা বলেই মা ফোনটা রেখে দিল।।


অর্ঘ চ্যাটার্জি